অথবা,পেশাদারি শাখা (Professional Branch) হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব লেখো।
ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিকের ভূমিকা :
সূচনা: বলা হয় ইতিহাস হল মানব জাতির অতীত কর্মকাণ্ডের কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিক লিখিত বিবরণ।
ইতিহাসের গুরুত্ব
[1] অতীতের ধারণাদানে: আর. জি. কলিংউড তাঁর 'দ্য আইডিয়া অব হিস্ট্রি' গ্রন্থে লিখেছেন ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক থেকে অতীতের যে ছবি বেরিয়ে আসে তা হল ইতিহাস। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব, মানুষের সভ্য দশা, বন্য দশা, সভ্যতার উদয় ও অগ্রগতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি সমস্ত কিছুরই ধারণা দেয় ইতিহাস। জে. বি. বিউরি এবং লিওপোল্ড ভন র্যাঙ্কের মতো ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন— ‘ঐতিহাসিকের কাজ হল শুধুমাত্র অতীত পুনর্গঠন করা এবং অতীত ঘটনাগুলিকে পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে উপস্থাপিত করা।’
[2] জ্ঞানের সুষম বিকাশে : ইতিহাসে আমরা খুঁজে পাই পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভৌগোলিক অবস্থান, সাহিত্যিক বিবর্তন, ভাষার বৈচিত্র্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞানের মানবক্রিয়া এবং অর্থনীতির নানারূপ। এ ছাড়াও মানব বিবর্তন, সভ্যতার উত্থানপতন, সাম্রাজ্যের উত্থানপতন, সমকালীন সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কারকাজ, মহাপুরুষদের উদ্যোগ, বিদ্রোহ, বিপ্লব, আন্দোলন প্রভৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করা যায় ইতিহাস থেকে। ঐতিহাসিক তাঁর লেখায় সুস্পষ্টভাবে এই বিষয়গুলি তুলে ধরেন।
[3] ঘটনার ধারাবাহিকতার অনুধাবনে: তুর্গো, কনডারসেট প্রমুখের ধারণায় ইতিহাস অনুন্নত থেকে ধীরে ধীরে উন্নত সভ্যতায় গিয়ে পৌঁছোয়। ঐতিহাসিক গিবন বলেন প্রত্যেক যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান বাড়ছে। ইতিহাস এই সমস্ত কিছুকেই ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে শুরু করে প্রায়-ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক পর্বের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে উঠে আসে। ঐতিহাসিক তার ইতিহাস লেখায় প্রাচীন যুগের নিদর্শনগুলি মধ্যযুগে এবং মধ্যযুগের নিদর্শনগুলি আধুনিক যুগের মানুষের কাছে উপস্থাপন করে।
[4] অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সম্পর্কস্থাপনে : ইতিহাস অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করে। তাই ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড হ্যালেট কার (E.H. Carr) বলেছেন, “ইতিহাস হল বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ।” ঐতিহাসিক কার আরও বলেছেন, বর্তমান যেমন অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। তেমনি অতীতকেও দেখা হয় বর্তমানের আলোকে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঐতিহাসিকের মাধ্যমে ইতিহাসে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকে।
[5] বর্তমানের ভিত্তি নির্মাণে: অতীতের ভিতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে। এই বর্তমানকে জানা ও বোঝার জন্য অতীত ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। আসলে ঐতিহাসিক বর্তমানের চোখে অতীতকে দেখে থাকেন। তিনি বর্তমানের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা অতীতের ওপর প্রয়োগ করে থাকেন। ফলশ্রুতি হিসেবে অতীত বর্তমানরূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
[6] আর্থ-সাংস্কৃতিক উন্নতির ধারণায় : প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি ও পশুপালনভিত্তিক অর্থনীতি কীভাবে শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হল তা জানা যায় ইতিহাস থেকে। এ ছাড়াও কোন্ ধরনের অর্থনীতি মানুষ ও রাষ্ট্রের পক্ষে কল্যাণকর বা কোন্ ধরনের অর্থনীতি দ্বারা একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে ধারণা দেয় ইতিহাস। এ ছাড়াও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বা বিবর্তনের ধারা বোঝা যায় ইতিহাস থেকে।
[7] সঠিক সত্য নিরূপণে : সভ্যতায় মানুষের অবদানের বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরতে গিয়ে ইতিহাস সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যকে অধিক গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করে। অপরদিকে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলিকে যতটা বেশি সম্ভব বাদ দিয়ে চলার চেষ্টা করে। নতুন নতুন সঠিক তথ্যের দ্বারা প্রচলিত তথ্যকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং বর্জন করে নতুন সর্বজনগ্রাহ্য সঠিক তথ্য উপস্থাপনা করে ইতিহাস। ফলে ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা সহজেই সঠিক সত্যটি নিরূপণ করতে পারি।
[৪] জাতীয়তাবাদের ও দেশপ্রেমের বিকাশে : ইতিহাস জনগণকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ও দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। ইতিহাস থেকেই বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ উন্মোচিত হয়। স্পেনের বিরুদ্ধে ওলন্দাজদের স্বাধীনতা আন্দোলন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম প্রভৃতি সম্পর্কে ইতিহাস থেকেই জ্ঞান লাভ করি।
উপসংহার: পেশাদারি শাখা হিসেবে ইতিহাসের নানাবিধ গুরুত্ব থাকলেও এর সবচেয়ে বড়ো গুরুত্ব হল—একটি দেশের অতীত সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা।