অব-উপনিবেশীকরণ:
[1] Decolonisation বা 'অব-উপনিবেশবাদ' কথার অর্থ হল ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, অর্থাৎ উপনিবেশবাদের বিপরীত ধারণা হল ‘অব-উপনিবেশবাদ'। জার্মান বিশেষজ্ঞ মরিৎস জুলিয়াস বন (Moritz Julius Bonn) ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম Decolonisa- tion শব্দটি ব্যবহার করেন। এককথায়, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিকে অব-উপনিবেশীকরণ বা Decolonisation বলা হয়। [2] অন্যভাবে বলা যায় যে, অব-উপনিবেশবাদ হল, পূর্বে কোনোঔপনিবেশিক শক্তির উপনিবেশ ছিল এমন কোনো দেশকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান। [3] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) পর থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি পশ্চিমি সার্বভৌম সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে তীব্র সংগ্রাম শুরু করলে অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনতা থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তির ঘটনাকে সাধারণভাবে অব-উপনিবেশীকরণ' (Decolonisation) বলা হয়।
প্রাচীন ও আধুনিক যুগের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র:
1. প্রাচীন যুগের উপনিবেশ: পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীনকালে মিশর, পারস্য, গ্রিস, রোম, ভারত প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ তাদের সীমানার বাইরের কোনো না কোনো দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তখন ভারতের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। মধ্যযুগে আরব এবং মোঙ্গলরাও দূরদেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
2. আধুনিক যুগের উপনিবেশ: আধুনিককালে উনবিংশ শতককে উপনিবেশবাদের সুবর্ণ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় ইউরোপের ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইটালি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, পোর্তুগাল, স্কটল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানও উপনিবেশের প্রসারে এগিয়ে আসে। পশ্চিমি শক্তিগুলি প্রধানত এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন দেশে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
অব-উপনিবেশীকরণের অর্থনৈতিক তাৎপর্য:
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ উপনিবেশ । বিদেশি শাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এসব দেশে অব- উপনিবেশীকরণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল।
1. অর্থনৈতিক দুর্বলতা : উপনিবেশের অর্থ ও সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি হস্তগত করে নিজেদের দেশের সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল। এদিকে ক্রমাগত শোষণের ফলে উপনিবেশগুলি দিনে দিনে নিঃস্ব ও দুর্বল হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির ওপরই এই উপনিবেশগুলি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে অব-উপনিবেশীকরণের পরেও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে দেশের কৃষি উৎপাদন, শিল্পায়ন প্রভৃতি ব্যাহত হয় এবং সামগ্রিক উন্নয়ন থমকে যায়। সদ্য-স্বাধীন এসব দেশে বেকারত্ব এবং কোথাও কোথাও খাদ্যাভাব তীব্র আকার ধারণ করে।
2. নয়া উপনিবেশবাদ : সদ্য-স্বাধীন দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও সেসব দেশে শীঘ্রই নয়া উপনিবেশবাদ শুরু হয় । কেন-না, সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি অর্থনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল ছিল। তাই তারা নিজেদের দেশের নিরাপত্তা, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রভৃতির প্রয়োজনে ইউরোপ বা অন্যান্য স্থানের বৃহৎ শক্তিগুলির ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। সুযোগ বুঝে বৃহৎ শক্তিগুলি সদ্য-স্বাধীন এসব দেশে অর্থনৈতিক সহায়তা দান করে সেখানে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।
3. আঞ্চলিক সহযোগিতা : অব-উপনিবেশীকরণের পরবর্তীকালে সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি সহযোগিতামূলক বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সামগ্রিক উন্নতির চেষ্টা চালায়। এসব সংগঠন যেসব বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়, সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
অব-উপনিবেশীকরণের সামাজিক তাৎপর্য:
1. বর্ণবৈষম্যবাদের বিরোধিতা: এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশে শাসক শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা শাসিত কৃষ্ণাঙ্গ প্রজাদের সঙ্গে তীব্র সামাজিক ব্যবধান ও অসাম্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অব-উপনিবেশীকরণের পর সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির বাসিন্দারা সচেতন হয় এবং বর্ণবৈষম্যবাদের তীব্র বিরোধী হয়ে ওঠে। এই বিরোধের ফলে বিশ্বে জাতিবৈরিতা ও বর্ণবৈষম্যবাদের গতি রুদ্ধ হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা, রোডেশিয়া থেকে বর্ণবৈষম্যবাদ বিদায় নেয়।
2. অস্থির পরিস্থিতি: এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হলেও কোনো কোনো উপনিবেশ তখনই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই পরিস্থিতিতে তারা স্বাধীনতা লাভ করলে দেশে সঠিক সুস্থ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। কিছু কিছু উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে তীব্র সংঘাত শুরু করে শক্তি ক্ষয় করে। আফ্রিকাসহ এশিয়ার বেশ কিছু উপনিবেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিভেদের ফলে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।
3. এলিট গোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধি : ঔপনিবেশিক শক্তি বিদায় নেওয়ার পর সদ্য-স্বাধীন বিভিন্ন দেশের শাসনক্ষমতা সেদেশের শিক্ষিত ও ধনী এলিট গোষ্ঠীর হাতে চলে আসে। তারা দেশে নিজ গোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষ ক্ষমতালাভে ব্যর্থ হয়।
অব-উপনিবেশীকরণের রাজনৈতিক তাৎপর্য
1. রাজনৈতিক দিগন্তের প্রসার: এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করলে বিশ্ব রাজনীতির দিগন্ত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি আরও প্রসারিত হয়। সদ্য- স্বাধীন দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
2. তৃতীয় বিশ্বের উত্থান: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু উপনিবেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এসব দেশ তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দেশগুলি পৃথিবী থেকে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য দূর করতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য দূর করতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাহায্য নেয়।
3. জাতিপুঞ্জের প্রসার: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য- স্বাধীন এসব দেশ জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জাতিপুঞ্জের ১৭৯টি সদস্যের মধ্যে ১০০টি সদস্য রাষ্ট্রই ছিল ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্র। সদস্য সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধির ফলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গুরুত্ব, পরিধি ও কার্যাবলির যথেষ্ট প্রসার ঘটে।
4. জাতিভিত্তিক নতুন বিশ্ব : অব-উপনিবেশীকরণের ফলে পুরোনো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির অধীনতা ছিন্ন করে জাতিভিত্তিক ক্ষুদ্র বৃহৎ অসংখ্য রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর এসব জাতি নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পায়।
5. সাম্রাজ্যবাদের গতিরোধ : অব-উপনিবেশীকরণের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। সদ্য-স্বাধীন এসব রাষ্ট্র ইতিপূর্বে দীর্ঘকাল ধরে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও আধিপত্যের যন্ত্রণা ভোগ করেছে। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত এসব দেশ স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা লাভের পর এসব দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতির বিজয়রথ অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
6. ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির কবল থেকে মুক্ত হলেও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব পড়ে। এসব রাষ্ট্রে সোভিয়েত রাশিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে সমাজতন্ত্রের প্রসারে এবং আমেরিকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন পুঁজিবাদের প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর তৃতীয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।