ইতিহাস রচনায় মিথ ও লেজেন্ডের গুরুত্ব:
মিথ-এর গুরুত্ব:
i. অতীতের দর্পণ হিসেবে: পৌরাণিক কাহিনিগুলি হল, ‘গল্পের আকারে সত্য ঘটনার প্রকাশ'। তাই পৌরাণিক কাহিনিকে সঙ্গী করে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা যায়। এই পৌরাণিক কাহিনিকে সম্বল করেই গ্রিসের প্রাচীন ট্রয় নগরী ও ট্রয় যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নির্ণয় করা গেছে।
ii.সময়কাল নির্ণয়: পৌরাণিক কাহিনি অতীতের অনেক ধারাবাহিক ছবি তুলে ধরে, ফলে এর মাধ্যমে ইতিহাসের সময়কাল নির্ধারণ করা যায়। পৌরাণিক কাহিনিগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই করে ইতিহাসের বহু সাল, তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
iii. বংশতালিকা নির্ধারণ: পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে প্রাচীনকালের বিভিন্ন রাজবংশের তালিকা জানা যায়। ঐতিহাসিক ড. রণবীর চক্রবর্তীর মতে, পুরাণে বর্ণিত বংশগুলির অস্তিত্বের বেশিরভাগই স্বীকৃত সত্য।
iv. ধর্ম-সংস্কৃতির অতীত ধারণালাভ : পৌরাণিক কাহিনি থেকে অতীতের সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেছেন, “বর্তমানে যা হিন্দুধর্ম বলে প্রতিভাত হয়, তার মুখ্য পরিচয় পুরাণে পাওয়া যাবে।”
কিংবদন্তির গুরুত্ব:
i. সভ্যতা নিরূপণ করা: বহু ক্ষেত্রেই কিংবদন্তি কাহিনিগুলিকে ইতিহাসের দর্পণে ফেলে সত্যকে তুলে ধরা হয়। যেমন—বাংলার কিংবদন্তি চরিত্র রঘু ডাকাতের কালীপূজার ভিত্তিতে বর্তমানে একটি কালী মন্দিরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ii. ঐতিহাসিক ভিত্তি : কিংবদন্তি কাহিনিগুলি ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যেমন—কিংবদন্তি চরিত্র বিক্রমাদিত্যের কার্যকলাপ আসলে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তেরই কার্যকলাপের বিবরণ।
iii. নতুন ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার : কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। বিভিন্ন কিংবদন্তির সূত্র ধরে পূর্ববঙ্গের সীতারকোটে পরীক্ষামূলক খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে (১৯৬৮ খ্রি.)।
iv. আর্থসামাজিক অবস্থার ধারণা দান: কিংবদন্তিগুলি সমকালীন আর্থসামাজিক অবস্থাকেও তুলে ধরে। সমকালীন সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক চিত্র উঠে আসে কিংবদন্তির হাত ধরে। যেমন—রবিন হুড কিংবদন্তি চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজে ধনীদরিদ্র বৈষম্যের দিকটি উঠে আসে।
ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব:
স্মৃতিকথা (Memories) হল ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। কোনো মানুষ অতীতের কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী হতে পারেন এবং সেই বিষয়ে তাঁর কাছে অনেক তথ্য থাকতে পারে। সেই ব্যক্তি এই ঘটনাগুলি পরবর্তীকালে স্মরণে এনে তা লিখিত আকারে প্রকাশ করতে পারেন। এই লিখিত তথ্য স্মৃতিকথা নামে পরিচিত। ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেমন—
(১) গুণীজনদের লেখা তথ্য: স্মৃতিকথাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন শাখার গুণী ব্যক্তিরা রচনা করেন। ফলে তাতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশ খুবই হ্রাস পায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। অবশ্য এবিষয়ে বিতর্ক আছে।
(২) বাস্তবতা: স্মৃতিকথাগুলি কাল্পনিক বিষয় নয়। এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দাঙ্গার ঘটনাবলি বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়।
(৩) প্রত্যক্ষ সাক্ষী: বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিবরণ তাঁদের স্মৃতিকথাগুলিতে আলোচনা করেন। ফলে উক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।
(৪) ঐতিহাসিক উপাদান: বিভিন্ন স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাক-বাহিনী পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের ওপর যে বর্বর ও নৃশংস অত্যাচার ও হত্যালীলা চালিয়েছিল তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল বিভিন্ন স্মৃতিকথাগুলি। কেননা, পাক সামরিক বাহিনী তখন পূর্ববাংলার সমস্ত সংবাদ গোটা বিশ্ব থেকে আড়াল করেছিল।