ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলন:
সূচনা : ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকালে সর্বাধিক শোষিত ও নির্যাতিত ছিল আদিবাসী ও দলিত শ্রেণি। ঔপনিবেশিক শাসন কালে ব্রিটিশ সরকার, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, মহাজন প্রভৃতি স্তরের অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও আদিবাসী দলিত সম্প্রদায়কে সমাজের উচ্চবর্ণের সামাজিক অবিচারের শিকার হতে হয়। নিম্নবর্গের মধ্যে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ই প্রথম ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে দলিতদের প্রতিরোধ শুরু হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে আদিবাসী ও দলিতদের এই আন্দোলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
আদিবাসী আন্দোলনের বিবরণ:
(১) চুয়াড় বিদ্রোহঃ ভারতের প্রথম আদিবাসী বিদ্রোহ ছিল ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত চুয়াড় বিদ্রোহ। মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত জঙ্গলমহল, বাঁকুড়া, সিংভূম, ঘাটশিলা প্রভৃতি অঞ্চলে ধমভূমের জগন্নাথ ধলের নেতৃত্বে চুয়াড় আদিবাসীরা বিদ্রোহে শামিল হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অঞ্চল চুয়াড় আদিবাসীরা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে, যার মূল কারণগুলি ছিল- কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের অত্যাচার, বেশ কয়েকবার অনাবৃষ্টি ও শস্যহানি যনিত দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি
(২) চাকমা বিদ্রোহ: ১৭৭৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দে শের দৌলত, রামু খাঁ প্রমুখের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম চাকমা কৃষক উপজাতি বিদ্রোহী হয়। এই বিদ্রোদের মূল কারণ ছিল ওই অঞ্চলে ইজারাদারি শোষণ।
(৩) কোল বিদ্রোহ: ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ছোটোনাগপুর অঞ্চলে হো, মুন্ডা, ওঁরাও, কোল সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসীগণ, জমিদার মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা ঘটায় তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন বুদ্ধ ভগত, জোয়া ভগত, ছিন্দরাই মানকি প্রমুখ। সীমাহীন দমন নীতির দ্বারা ক্যাপটেন উইলকিনস এই বিদ্রোহ দমন করেন।
(৪) সাঁওতাল বিদ্রোহ: ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ। হাজারীবাগ, মানভূম থেকে শুরু করে রাজমহল পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা বিদ্রোহে শামিল হয়। যার কারণগুলি ছিল-
(ক) সাঁওতালদের ধর্মান্তকরণের চেষ্টা।
(খ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর সাঁওতালদের ওপর অতিরিক্ত খাজনার দাবি ও জমিদারি উৎপীড়ন।
(গ) সাঁওতাল পরগণায় বহিরাগত (দিকু) দের অত্যাচার।
বীর সিং মাঝি, গোক্কর প্রমুখ অন্যান্য নেতাদের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করলে তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর ডালহৌসী অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে কয়েক হাজার সাঁওতালদের হত্যা করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করেন।
(৫) মুন্ডা বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বীরসা মুন্ডা স্বাধীন মুন্ডা রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহের সূচনা করে তা 'মুন্ডা বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। যার কারণগুলি ছিল-
(ক) মুন্ডাদের উপর খাজনার হার বৃদ্ধি।
(খ) খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব বৃদ্ধি।
(গ) মুন্ডাদের যৌথ মালিকানা প্রথার (খুঁৎকাঠি ব্যবস্থা) অবসান।
(ঘ) বেগার শ্রম বৃদ্ধি প্রভৃতি।
মুন্ডা বিদ্রোহ ব্রিটিশদের অস্বস্তির কারণ হলে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বীরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করলে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
(৬) চঞ্জু বিদ্রোহ: দক্ষিণ অন্ধ্রে কুপনা, নেলোর অঞ্চলে নাল্লামালাই পার্বত্য উপজাতিদের আদিম খাদ্য সংগ্রহের অধিকার খর্ব করা হলে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অরণ্য কমিটি গড়ে, এরা অসহযোগ আন্দোলনের সময় এখানে ‘অরণ্য সত্যাগ্রহ’ শুরু করে।
(৭) রাম্পা বিদ্রোহ: গোদাবরী পার্বত্য অঞ্চলের রাম্পা অঞ্চলে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আলুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে মহাজন ও সরকার অরণ্য বিরুদ্ধে রাম্পা জনজাতি যে বিদ্রোহের সূচনা করে তা রাম্পা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
দলিতদের আন্দোলনের বিবরণঃ
ভারতে হিন্দু সমাজ কাঠামোয় জাতভিত্তিক বিভাজন মানুষে মানুষে কালক্রমে এমন বিভেদ সৃষ্টি করেছিল যে সমাজের কিছু জাতি অধঃপতিত, অদ্ভুত হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। এরাই দলিত পরিগণিত। কোম্পানি আমলে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য এই দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল -
(১) এজহাবা সম্প্রদায়ের আন্দোলন: দক্ষিণ ভারতের কেরালায় এজহাবা সম্প্রদায় ছিল দলিত। তারা শ্রী নারায়ণ গুরুর নেতৃত্বে সমাজে ব্রাহ্মণ্য প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। তারা হিন্দু হলেও তাদের হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না, মন্দিরের চলার পথ দিয়ে চলার অধিকার ছিল না। তারা প্রথম ভাইকম সত্যাগ্রহের মাধ্যমে পথ চলার অধিকার লাভ করে এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অণুকরণ করে নিজেদের সামাজিক অবস্থানে উন্নতির চেষ্টা করে।
(২) নাদার সম্প্রদায়ের আন্দোলন: দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ুর দক্ষিণ নাদার সম্প্রদায় অনুরূপ আন্দোলন করে। এই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ব্যবসা বা অন্য কাজ করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠে এবং নিজেদের হীন সামাজিক অবস্থানকে উন্নত করার চেষ্টা করে। এরপর মন্দিরে প্রবেশের (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে) দাবিকে কেন্দ্র করে উঁচু জাতের সঙ্গে দলিতদের দাঙ্গা বাঁধে।
(৩) দলিত পল্লি সম্প্রদায়ের আন্দোলন: তামিলনাড়ু উত্তরে দলিত পল্লি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। খেতমজুর, পশুচারণ ও বিভিন্ন কাজ করে তার জীবিকা নির্বাহ করত। এই সম্প্রদায়ের একটি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সচ্ছলতা লাভ করে নিজেদের বানিয়া ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। তারা ব্রাহ্মণদের অনুকরণ করে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ করে।
(৪) মাহার সম্প্রদায়ের আন্দোলন: মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায় ছিল দলিত গোষ্ঠী। ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর এই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে বাবা ভালংকার নামে একজন প্রাক্তন সেনাকর্মীর নেতৃত্বে মাহাররা জোটবদ্ধ হয়। ভালংকার তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য সেনাবাহিনী ও সরকারি কাজে নিয়োগের দাবি জানায়।
১৯৪২ সালে আম্বেদকর সর্বভারতীয় তপশিলি জাতি ফেডারেশন গঠন করলে রাজনৈতিক গুরুত্ব দলিতদের বেড়ে যায়।