মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদঃ

মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস” (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ’ (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো।

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?


মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ


(1) আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ।

(2) মূল্যবান ধাতুর ওপর গুরুত্ব আরোপ: মার্কেন্টাইল মতবাদে সোনা, রুপো-সহ মূল্যবান ধাতুর বহির্গমন হয় সঞ্চয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। চোদ্দো এবং পনেরো শতকে এই নীতি মেনে স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড-সহ নৌ-শক্তিতে শক্তিশালী দেশগুলি নিজ নিজ উপনিবেশ থেকে সোনা, রুপো-সহ মূল্যবান ধাতুগুলি লুঠ করে নিজ নিজ দেশে আনতে শুরু করে।

(3) আমদানি হ্রাস, রপ্তানি বৃদ্ধি: মার্কেন্টাইল মতবাদে আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর কথা বলা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশে মূল্যবান ধাতুর আগমনের পরিমাণ বাড়ে ওপরদিকে তেমন দেশে বিভিন্ন ধরনের উৎপাদক ও বণিকরা নতুন নতুন বাণিজ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেখায়। অধিক পণ্য রপ্তানি করা গেলে পণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতাদের মুনাফা বাড়ে। অতিরিক্ত মুনাফা জমতে জমতে পুঁজির পরিমাণও বাড়ে। ফলে অতিরিক্ত পুঁজি বা মূলধন নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের কাজে লাগানো যায়।

(4) অবাধ বাণিজ্যের বিরোধিতা: মার্কেন্টাইল মতবাদে বলা হয় অন্য দেশের স্বার্থ রোধ করে নিজের দেশের বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো উচিত। এই উদ্দেশ্যে অন্য দেশের বাণিজ্যনীতির ওপর আমদানি শুল্ক চাপিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত এবং নিজের দেশের শিল্পোদ্যোগ ও শিল্পনীতিকে শুল্কমুক্ত করে ও ভরতুকি দিয়ে উৎসাহ জোগানো উচিত। অবাধ বাণিজ্যের পরিণতি হিসেবে নৌ-শক্তিতে শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (war for trade) জড়িয়ে পড়ে।

(5) কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ : মার্কেন্টাইল মতবাদে কৃষির বাণিজ্যি কিকরণের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। এই মতবাদে বলা হয় দেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানি করলে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। তাই সরকারের উচিত দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যকে দেশের বাইরে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহ যোগানোর জন্য। কর মুকুবের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হয়। এই নীতি মেনেই। সে সময়ে ইউরোপের কৃষকগণ নিজ নিজ পরিবারের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে এবং সরকারি খাজনা পরিষোধের জন্য খাদ্য শস্যের উৎপাদন শুরু করে।

(6) শিল্পবাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ : দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে রাষ্ট্র উদ্যোগ নেবে বলে উল্লেখ করা হয় এই মতবাদে। দেশের কোনো বণিক গোষ্ঠী বা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যের প্রসার বা শিল্প স্থাপনের সাহায্যের জন্য রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাতেই দেশের মধ্যেশিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এই নীতি মেনেই ইংল্যান্ডে নেভিগেশন আইন জারি হয়। ফ্রান্সে ফরাসি মন্ত্রী কোলবার্ট সরকারি অর্থ নিয়ন্ত্রণ নীতি জারি করেন। কোলবার্ট বলেন সার্বভৌম্য রাষ্ট্রের সম্পদ এবং ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসরণ করা উচিত।

(7) ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দান: মার্কেন্টাইল মতবাদে ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো বণিক বা শিল্পপতি নিজের পুঁজিকে বাণিজ্যিক পণ্য বা শিল্প পণ্য উৎপাদনে কাজে লাগাতে পারবে। এতে একদিকে যেমন দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত পুঁজির যোগান বাড়বে অপরদিকে তেমন দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে মূলধনের পরিমাণও স্ফীত হবে। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের আগে এইধরনের ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। ব্যক্তিগত পুঁজির যোগান ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবে উত্থান ও প্রসারে সাহায্য করে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন