বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ:
সূচনা: ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়।
(1) মিথ্যা মামলায় জড়ানো: শেখ মুজিবুরসহ অন্যান্য আওয়ামি লিগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগে পাক সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুরসহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পাক সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
(2) সাধারণ নির্বাচন: পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার- বিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পাটি ৮১টি আসন পায়। এভাবে পাক জাতীয় পরিষদে আওয়ামি লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান আওয়ামি লিগের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে জাতীয় অধিবেশন স্থগিত করে দেয় (১ মার্চ, ১৯৭১ খ্রি.)। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
(3)‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা: পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সেখানকার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঘোষণা করেন যে, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। ২৬ মার্চ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এভাবে ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
(4) গণহত্যা: পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে পাক সেনাবাহিনী পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর নৃশংসভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। মৌলবাদী আল-বদর, আল-সামস প্রভৃতি রাজাকার বাহিনী (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানকার কিছু কিছু মৌলবাদী মুসলিম নেতা মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করে। এই মৌলবাদী নেতারা রাজাকার বাহিনী নামে পরিচিত) পাক সেনাবাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসে। সশস্ত্র পাক বাহিনী পূর্ববঙ্গে দীর্ঘ ২৬৭ দিন ধরে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বে এটি সবচেয়ে বড়ো গণহত্যা বলে মনে করা হয়। এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড পূর্ববঙ্গের মানুষকে আরও বেশি করে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।
(5) প্রবাসী সরকার: এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে একটি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। এই সরকার ভারতের মাটি থেকে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে।
(6) স্বাধীনতা লাভ: ক্রমে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের সহায়তায় পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পাক সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে বাংলাদেশ নামে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা:
পাক সরকার শেখ মুজিবুরকে গ্রেপ্তার করলে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে আশ্রয় নেয়। তারা এখানে ১০ এপ্রিল (১৯৭১ খ্রি.) অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সরকারের উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মুজিবুর রহমান বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকেই কার্যনির্বাহী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই সরকার ভারতের মাটি থেকে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে। পাক সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার কালে পাক হামলা থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। ফলে ভারত প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি, পূর্ববঙ্গের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভারতের সহায়তায় পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পাক সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। ভারত ও ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে প্রায় ৯০ হাজার পাক সেনাকে বন্দি করে। অবশেষে পাক বাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি ১০,০০০ সৈন্যসহ ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১ খ্রি.) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-র কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
উপসংহার: স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির উদ্যোগে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তরিক মৈত্রী গড়ে ওঠে।