ভিয়েনা কংগ্রেসের নীতিগুলি সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।

ভিয়েনা কংগ্রেসের নীতি

ভিয়েনা কংগ্রেসের নীতিগুলি সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।


        নেপোলিয়নের পতনের পর সামগ্রিকভাবে ইউরোপের পুনর্গঠনের প্রশ্ন আলোচনার জন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। ভিয়েনা সম্মেলনে (১৮১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দ) যোগদানকারী বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদগণ ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন, ইউরোপের সমাজব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে ইউরোপের পুনর্গঠন, ইউরোপের অখণ্ড শক্তিস্থাপন প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের কথা ঘোষণা করলেও কার্যক্ষেত্রে তাঁরা এই সকল ঘোষিত নীতি অনুসরণ করেননি। ইউরোপের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ফরাসী বিপ্লবের পূর্বাবস্থার পুনঃস্থাপন এবং নিজ নিজ দেশের স্বার্থরক্ষা করা।

       এই সম্মেলনে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ সর্বপ্রধান অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন রাশিয়ার সম্রাট প্রথম আলেকজাণ্ডার, ইংল্যাণ্ডের বৈদেশিক মন্ত্রী ক্যাসলরি, প্রশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়াম ও চ্যান্সেলর হার্ডেনবাগ, ফ্রান্সের অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ ট্যালির‍্যাণ্ড। তুরস্ক ব্যতীত ইউরোপের সকল দেশের রাজপুরুষেরাও এই সম্মেলনে যোগ দেন। অভিজাত শ্রেণী অলঙ্কৃত এই মহাসম্মেলনে অবশ্যই কোন জনপ্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারেন নি।

      নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্যের পতনে উদ্ভূত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবর্গ কয়েকটি নির্দিষ্ট নীতির কথা ঘোষণা করেন; যথা- (ক) ন্যায্য অধিকার, (খ) ক্ষতিপূরণ ও পুরস্কার দানের নীতি এবং (গ) শক্তিসাম্যের নীতি।

       ন্যায্য অধিকার নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে যতদূর সম্ভব প্রাক্-বিপ্লব যুগকে ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের আগে যে ভূমি যে দেশের বা রাজবংশের অধীনে ছিল, সেই ভূমি সেই দেশ বা বংশের অধীনে ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল এই নীতির মূল বক্তব্য। এই নীতির বলে বিপ্লব-পূর্ব সীমানাই ফ্রান্সের নতুন বৈধ রাজ্যসীমা হিসেবে স্বীকৃত হয়। বুরবো বংশীয় অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের নতুন রাজা হন। এইভাবেই স্পেন, সিসিলি ও নেপলসে বুরবোঁ বংশ, হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ, সার্ডিনিয়া-পিডমন্টে স্যাভয় বংশ এবং মধ্য ইতালিতে পোপের কর্তৃত্ব ফিরে আসে। উত্তর ইতালি ও জার্মানির ওপর অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

        ক্ষতিপূরণ নীতি অনুযায়ী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেসব দেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন, ফিনল্যান্ড ও বেসারাবিয়া-সহ পোল্যান্ডের ৩/৪ অংশ রাশিয়াকে দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়া তার নিজের হারানো অংশ ছাড়াও ইতালির ভেনেসিয়া ও লম্বার্ডি লাভ করে। প্রাশিয়া পোল্যান্ডের বাকি ১/৪ অংশ ও সাক্সনির ২/৫ অংশ ছাড়াও, নেপোলিয়ন কর্তৃক অধিকৃত তার সমস্ত অঞ্চল ফিরে পায়। ইংল্যান্ড ইউরোপের বাইরের মাল্টা, মরিশাস, সিংহল, ত্রিনিদাদ, উত্তমাশা অন্তরীপ প্রভৃতি স্থান লাভ করে। সুইডেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে পায় নরওয়ে। পোপকে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

       শক্তিসাম্য নীতির দ্বারা ভবিষ্যতে ফ্রান্স যাতে আবার শক্তি সঞ্চয় করে ইউরোপের শান্তিভঙ্গ করতে না পারে এবং সেই সঙ্গে বিজয়ী শক্তিবর্গও যাতে একে অন্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে না ওঠে, তার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে, ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য সেখানে মিত্রপক্ষের সেনাদল মোতায়েন করা হয়। তা ছাড়া ফ্রান্সের চারপাশে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। এই কারণে ফ্রান্সের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, পূর্ব সীমান্তে জার্মানির রাইন প্রদেশগুলিকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডকে ফ্রান্সের তিনটি জেলা দেওয়া হয়, দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত সার্ডিনিয়ার সঙ্গে জেনোয়াকে যুক্ত করা হয়। শক্তিসাম্য নীতি দ্বারা অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যাতে সমান ক্ষমতা বণ্টিত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়। 

        ভিয়েনা সম্মেলন ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়। এই সম্মেলনে যোগদানকারী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার পারস্পরিক বিরোধ, আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে মোটামুটি এক ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন