হিউগেনো
সংস্কারক জন ক্যালভিন (John Calvin)-এর স্বদেশ ফ্রান্সের ক্যালভিন পন্থীরা হিউগেন (Heugenots) নামে পরিচিত ছিলেন। ক্যালভিন প্রথমে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের এবং অপ্রতিরোধ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রাজকীয় স্বৈরাচারের দৃষ্টান্ত তাঁর চিন্তায় পরিবর্তন ঘটায় এবং তিনি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে বৈধ বলে স্বীকার করেন। ক্যালভিন-এর এই স্বীকৃতির পেছনে ছিল স্বদেশে তাঁর অনুগামী হিউগেনদের নিরাপত্তার চিন্তা। হিউগেনদের ক্ষেত্রে ক্যাথলিক রাজার সহিষ্ণুতা ছিল অত্যাবশ্যক। কিন্তু ফরাসি সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে হিউগেনরা প্রথম থেকেই নির্যাতিত হচ্ছিলেন। ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিস ক্যাথলিকবাদের সমর্থক হলেও, প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে সমঝোতা করতে চলতে প্রথমে ইচ্ছুক ছিলেন। ফ্রান্সের প্রোটেস্ট্যান্টরা মনে করেছিলেন যে রাজা তাঁদের মত প্রকাশের বিরোধিতা করবেন না। তাই ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা প্যারিস শহরে ক্যাথলিক বিরোধী এক সমাবেশের আয়োজন করেন। কিন্তু রাজা মধ্যপন্থী থেকে সরে আসেন এবং অসংখ্য প্রোটেস্ট্যানকে গ্রেপ্তার করেন এবং বুঝিয়ে দেন যে, প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্ষমতা বৃদ্ধি তিনি বরদাস্ত করবেন না। এমতাবস্থায় ক্যালভিন নিজে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তাঁর প্রতিরোধের তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন আনেন। হিউগেন নেতার কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানান যে, সাধারণ প্রজাদের ‘প্রতিরোধ’ বিষয়ে তাঁর মত অপরিবর্তিত থাকলেও, Priness of the blood রা যদি Perliament-এর দ্বারা সমর্থিত হয়ে নিপীড়ক রাজার বিরোধিতা করে তবে তা বৈধ। এই তত্ত্ব ফ্রান্সের সংখ্যালঘু হিউগেনদের রক্ষা কবচে পরিণত হয়।
হিউগেনরা নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। স্বৈরাচারি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারিত তত্ত্ব সম্বলিত দুটি গ্রন্থ হল-ফ্রাঙ্কোগালিয়া (Francogallia) এবং ভিভিসিয়া কন্ট্রাটিরেনাস (Vindicia Contratirenus)। তবে হিউগেনরা তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে মানুষের বিপ্লবের উপাদানকে সতর্কভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের আকস্মিক মৃত্যুর পর রাজমাতা ক্যাথারিনের তত্ত্বাবধানে নাবালক দশম চার্লস ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলে হিউগেনদের সাথে ক্যাথোলিকদের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ক্যাথারিন হিউগেনদের ধর্মীয় সম্মেলন আহ্বান করার অধিকার সংকুচিত করেন। ভাসি শহরে হিউগেন সম্মেলনের উপর রাজকীয় বাহিনী আক্রমণ করলে ফ্রাশে ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৫৭২-এ সেন্ট বার্থেলমো (Sent Barthelmo)-এর উপাসনার দিনে প্রায় ৩০ হাজার হিউগেনকে হত্যা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৫৭৬-এ প্যারিস ও রাজকীয় নগরগুলি ছাড়া অন্যত্র প্রোটেস্ট্যান্টদের (Heuganots) ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়। অবশ্য ক্যাথলিকরা এই সমাঝোতাকে ভালো চোখে দেখেননি। ১৫৯০-এর দশকে এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। শেষ পর্যন্ত ১৫৯৮-এ হিউগেনদের দাবি মেনে নিয়ে ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করা হয় এবং উচ্চ সরকারি পদে হিউগেনদের নিয়োগ মেনে নেওয়া হয়।