আলভার এবং নায়নার
সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে তামিলনাডুতে, বৈষ্ণব মতবাদের প্রচারকগণ আলভার ও ভক্তিবাদের প্রচারকগণ নয়নার নামে পরিচিত ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর প্রাচীনতম বৈষ্ণব সম্প্রদায় আলভার নামে পরিচিত। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তামিলনাডুতে আলভারদের প্রচারের ফলে বৈষ্ণবধর্ম খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আলভার সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গকে আচার্য বলা হত। আচার্যদের মধ্যে বিশেষভাবে সিদ্ধিলাভ করেন নাথমুনি, যমুনাচার্য এবং রামানুজ। আলভার আচার্যগণ বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ ছাড়াও প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু করেন।
আলভার আচার্যদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন রামানুজ। কাঞ্চীতে বিদ্যার্জন করার পর রামানুজ চোলরাজ অধিরাজেন্দ্রের রাজ্যের অন্তর্গত ত্রিচিনোপলির নিকট শ্রীরঙ্গমে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু শৈব ধর্মাবলম্বী রাজা অধিরাজেন্দ্রের বিরোধিতার জন্য তিনি শ্রীরঙ্গম ত্যাগ রতে বাধ্য হন এবং জৈন ধর্মাবলম্বী হোয়সলরাজ বিট্রিগ-এর রাজ্যের অন্তর্গত মহীশূরে আশ্রয় নেন। অল্প দিন পরে রাজা বিট্টিগ (১১১০-১১৪১ খ্রিস্টাব্দ) রামানুজ কর্তৃক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন এবং রাজা বিট্টিগ তখন বিষ্ণুবর্ধন নাম গ্রহণ করেন এবং তিনি বেলুর ও হাবেঠিদ-এ সুন্দর সুন্দর বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করেন। শেষ জীবনে রামানুজ পুনরায় শ্রীরঙ্গমে ফিরে এসে আমৃত্যু সেখানে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, শঙ্করাচার্য প্রচারিত ‘অদ্বৈতবাদের’ তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বেদান্ত সম্বন্ধে একটি নতুন মতবাদ প্রচার করেন। তাঁর প্রচারিত মতবাদ ‘বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ’ নামে পরিচিত।
আলভারদের মতো দক্ষিণ ভারতে নায়নার সম্প্রদায় শৈবধর্মের মাধ্যমে ভক্তিবাদের প্রচার করেন। নয়নারগণ শিব বা মহেশ্বর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্য তাঁরা শৈব মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। এই সময় দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীগণ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের মুখপাত্র হিসাবে আলভারগণ বৈষ্ণব মতবাদ এবং নয়নারগণ শৈব মতবাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা প্রকাশ্যে বৌদ্ধ ও জৈনদের বিতর্কে আহ্বান জানান এবং ধর্মের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য জনসমক্ষে উপস্থিত হতে অনুরোধ করেন। নয়নারগণ কয়েকজন উপযুক্ত সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে নৃত্যগীত সহকারে দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র তাঁদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন স্থানে তাঁরা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও জৈন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ধর্মীয় মতবাদ সংক্রান্ত বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। কিংবদন্তী অনুসারে ৭৩ জন নয়নার সন্ন্যাসীর নাম জানা যায়, তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ তিনজন হলেন তিরুণবুক বা তিরুভমুর-এর আপিয়ার, তাঞ্জোরের নামসম্বন্দর এবং নারালুর-এর সুন্দরমূর্তি। তাঁদের রচিত স্তোত্রসমূহ ‘দেবরাম’ নামে গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। এইসব স্তোত্র ধর্মীয় সাধনার অভিজ্ঞতা ও হস্যবাদের মূল্যবান রত্ন হিসাবে বিবেচিত হয়।