কনসার্ট অফ ইউরোপ বা ইউরোপীয় শক্তি সমবায় পতনের কারণগুলি কী ছিল ?

কনসার্ট অফ ইউরোপ পতনের কারণ

কনসার্ট অফ ইউরোপ বা ইউরোপীয় শক্তি সমবায় পতনের কারণগুলি কী ছিল ?

        ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়া-ভিয়েনা সম্মেলনের এই চার বৃহৎ শক্তি ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা যাতে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে সেইজন্য নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। চতুঃশক্তি মৈত্রী নামে পরিচিত এই চুক্তিকে ভিত্তি করে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে মিলননীতি স্থাপিত হয়, ইতিহাসে তা-ই ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অফ ইউরোপ (১৮১৫ খ্রি.) নামে খ্যাত। পরে ফ্রান্স এই শক্তি সমবায়ে যোগ দেয়। ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠনের মধ্যে দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পরে নেপোলিয়নের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলি ইউরোপ জুড়ে যে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য গঠিত হয় কনসার্ট অব ইউরোপ। এই সংগঠন চেয়েছিল ইউরোপীয় রাজবংশগুলিকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই শক্তি-সমবায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । এর ব্যর্থতার জন্য একাধিক কারণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। 

  প্রথমত, শক্তি-সমবায় গঠনের পশ্চাতে প্রধান উপাদান ছিল নেপোলিয়ন-সম্পর্কিত ভীতি। এটিকে তাই বলা হয় ‘নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের উপজাত’। এক ও অভিন্ন শত্রু নেপোলিয়নকে জব্দ করার জন্য বৃহৎ শক্তিরা নিজেরের স্বার্থদ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে একত্রিত হয়েছিল। কিন্তু ফরাসি-বিপ্লব ও নেপোলিয়নের প্রভাব যত কমতে থাকে, ততই তাদের নিজেদের স্বার্থ-দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এই চরম পরিণতি ঘটে সমবায়ের পতনের মধ্য দিয়ে।  

 দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় শক্তিগুলির জাতীয় স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা এবং পারস্পরিক সন্দেহ ও প্রতিযোগিতা এর পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। উদ্দেশ্য ও আদর্শের অভিন্নতা ছাড়া কোনো সংগঠনের পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। জার প্রথম আলেকজান্ডার অন্যান্য শক্তির সহায়তায় ইংল্যান্ডের অগ্রগতিকে রোধ করতে চেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে, ইংল্যান্ড চেয়েছিল অন্যান্য রাষ্ট্রের সাহায্যে বল্কান অঞ্চলে বুশ-অগ্রগতি রোধ করতে। এই বিভিন্নতার জন্যই বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি কখনোই কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

 তৃতীয়ত, স্বার্থদ্বন্দ্বের মতো সমবায়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির আদর্শগত সংঘাতও ছিল প্রবল। ইংল্যান্ড ছিল উদারতান্ত্রিক কিন্তু অন্যান্যরা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। তাই উদারতন্ত্রী ইংল্যান্ডের সাথে রক্ষণশীল অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখা দেয়। ডেভিড টমসন বলেছেন, “রক্ষণশীল শক্তিগুলি ইউরোপীয় শক্তি-সমবায়কে মনে করেছিল বিপ্লব-বিরোধী একটি বাঁধ, কিন্তু ইংল্যান্ড মনে করেছিল এটি একটি সুইস গেট, যার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় উদারনীতির ঢেউ মুক্তি পাবে”। এই আদর্শগত বিরোধ-এর পতনের জন্য যথেষ্ট দায়ী ছিল।

 চতুর্থত, ইংল্যান্ড শক্তি-সমবায় পরিত্যাগ করলে সমবায় দুর্বল হয়ে যায়। মতভেদের দরুন ভেরোনা-বৈঠকের পর ইংল্যান্ড শক্তি-সমবায় থেকে সরে দাঁড়ায়। নবাগত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যানিং- এর ধারণা ছিল যে, শক্তি-সমবায়ে যোগদানের ফলে ইংল্যান্ড অপদস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই স্পেনীয় উপনিবেশ সমবায়ের হস্তক্ষেপের কারণে তিনি শক্তি-সমবায় থেকে ইংল্যান্ডকে সরিয়ে নেন। অতঃপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মনরো তাঁর “আমেরিকা আমেরিকাবাসীর জন্য” এই তত্ত্ব ঘোষণা করলে শক্তি-সমবায় চুপসে যায়। ইংল্যান্ডের পদত্যাগ ও আমেরিকার হুমকির ভয়ে ভীত শক্তি-সমবায় তাদের ঘোষিত পরিকল্পনাগুলি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে শক্তি-সমবায়ের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়।

 পঞ্চমত, শক্তি-সমবায় ভিয়েনা-সম্মেলনের সিদ্ধান্ত- গুলিকে অলঙ্ঘনীয় ভেবে মহাভুল করেছিল। ডেভিড টমসনের মতে, শক্তি-সমবায়ের উচিত ছিল ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলিকে স্বীকার করা। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী উত্থানকে রক্ষণশীলতা দ্বারা রোধ করার প্রচেষ্টার অর্থই ছিল ইতিহাসের গতির বিরুদ্ধে যাওয়া। স্বভাবতই এর পতন ও অবসান ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন