মহাদেশীয় অবরোধ
অসামান্য নৌ-শক্তির অধিকারী ইংল্যান্ডকে পরাজিত করা অপেক্ষাকৃত দুর্বল নৌ-শক্তি সম্পন্ন ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নেপোলিয়ান নিজেই ফ্রান্সের এই দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন ইংরেজ নৌ-সেনাপতি নেলসন-এর হাতে নীলনদের যুদ্ধ ও ট্রাফালগারের যুদ্ধ দুটিতে পরাজিত হবার পর। ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে এ্যামিয়েন্সের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় বটে, তবে ঐ সন্ধি মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গঠিত তৃতীয় শক্তিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও রাশিয়া পর পর যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করলেও ইংল্যাণ্ড অপরাজিত থেকে যায়। ইতোমধ্যে মধ্য ইউরোপে স্বীয় শক্তি প্রতিষ্ঠিত করে নেপোলিয়ান ইংল্যান্ডকে অর্থনৈতিক অবরোধের সাহায্যে ধ্বংস করতে চান। তাঁর মতে ইংল্যাণ্ড ছিল ‘দোকানদারের জাত’। তাদের বাণিজ্য বিনষ্ট হলে ইংরাজ জাতি তাঁর সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হবে এবং তখনই সমগ্র ইউরোপে ফরাসী কর্তৃত্ব সৃষ্টি হবে। তাঁর ধারণা ছিল ইউরোপের ফ্রান্স- অধিকৃত বাজারগুলিতে ইংল্যাণ্ডে প্রস্তুত মাল আমদানি নিষিদ্ধ হলে বাজারগুলিতে ফরাসী মালের চাহিদা বাড়বে, ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। তাই মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণার মূলে ছিল ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ। এই পদ্ধতি অবশ্য ডাইরেক্টরী আমলে সর্বপ্রথম গৃহীত হয়েছিল। নেপোলিয়ান সেই নীতিকে জোরদারভাবে কার্যকর করতে সচেষ্ট হন।
নেপোলিয়ান ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দে বার্লিন ডিক্রী ঘোষণা করে ইংল্যাণ্ডের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ জারী করেন। এই ঘোষণায় বলা হয় যে ফ্রান্স বা তার মিত্র দেশ বা নিরপেক্ষ দেশের বন্দরগুলিতে ইংল্যাণ্ড বাণিজ্যিক সম্ভার রপ্তানি করতে পারবে না। অন্য কোনও দেশের জাহাজে করে ইংল্যান্ডীয় মাল রপ্তানি করা হলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
ইংল্যান্ড এর জবাব দেয় ‘অডার্স-ইন কাউন্সিল’ জারি করে। যাতে বলা হয়, নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির পণ্যবাহী জাহাজগুলিকে কোনও ইংরাজ বন্দরে প্রবেশ করতে হলে বৃটেনের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এই নির্দেশ অমান্য করলে পণ্যবাহী জাহাজগুলিকে বৃটেন বাজেয়াপ্ত করবে। বৃটেনের ব্যবস্থার প্রত্যুত্তরে নেপোলিয়ান আরও দুটি ঘোষণা জারী করেন তাঁর পূর্ববর্তী ঘোষণার পরিপূরক হিসাবে, যথা-মিলান ডিক্রি ও ফন্টেনব্লু ডিক্রি। এগুলিতে নির্দেশ দেওয়া হয় শত্রু-মিত্র অথবা নিরপেক্ষ কোনও দেশের জাহাজকে ব্রিটেন বা তার উপনিবেশের বন্দরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই আদেশভঙ্গকারী ইংরাজ জাহাজ ও তাদের পণ্য ফ্রান্স বাজেয়াপ্ত করবে ও ধ্বংস করবে। বাণিজ্যিক অবরোধ সংক্রান্ত এইসব ডিক্রিগুলির নির্দেশ একযোগে ‘মহাদেশীয় অবরোধ’ নামে পরিচিত।
মহাদেশীয় অবরোধ এবং নেপোলিয়ানের পতন:
মহাদেশীয় অবরোধ কার্যকর করতে হলে ফরাসী সম্রাটের হাতে প্রচুর নৌ-বল থাকার দরকার ছিল। কিন্তু নেপোলিয়ানের নৌ-বল ছিল খুবই দুর্বল। অপরদিকে বৃটেন তার নিজস্ব ঘোষিত নির্দেশগুলিকে নৌ-বাহিনীর দাপটে কার্যকর করতে সক্ষম ছিল। এই সংকটে ইংল্যান্ডের পক্ষে বিশ্ব-বাণিজ্য চালু রাখাও অসম্ভব হয় নি; অবশ্য এ কথা ঠিক নয় যে মহাদেশীয় অবরোধ বৃটেনের পক্ষে ক্ষতিকর হয় নি। ফ্রান্সের ক্ষতিই বেশি হয়েছিল। চোরা পথে ইউরোপের বাজারগুলিতে মাল পাচার করা ইংল্যাণ্ডের পক্ষে সম্ভব ছিল। তাছাড়া ইউরোপের ঘরে ঘরে ইংল্যাণ্ডে প্রস্তুত সামগ্রীর দারুণ চাহিদা ছিল। ফ্রান্সের কারখানায় তৈরি মালের চাহিদা তেমন ছিল না; ফ্রান্স তখন শিল্পক্ষেত্রে ইংল্যাণ্ডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। সর্বোপরি ইংল্যান্ডের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার দরুন ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তাদের আর্থিক সমৃদ্ধির অবনতি হতে শুরু করে। নিরপেক্ষ দেশগুলি এজন্য মহাদেশীয় অবরোধ ছিন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে না-পারায় নিরপেক্ষ দেশগুলিতে জনতার অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। নেপোলিয়ানের জনপ্রিয়তা বিনষ্ট হতে থাকে। নিরপেক্ষ রাজ্যের অধীশ্বর পোপ মহাদেশীয় নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ান তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। তার পরিণতিতে সারা ক্যাথলিক দুনিয়াতে নেপোলিয়ান-বিরোধী ক্ষোভ দেখা দেয়। স্বাধীন পর্তুগালের রাজা মহাদেশীয় নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ান পর্তুগালে সেনা পাঠান। এজন্য তিনি স্পেনের মধ্যে সসৈন্যে প্রবেশ করেন। স্পেন সরকারকেও মহাদেশীয় অবরোধ মানতে বাধ্য করেন। স্পেনের বুরবোঁ রাজাকে হঠকারিতা করে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং নিজ ভ্রাতা জোসেফকে স্পেনের রাজপদে অধিষ্ঠিত করেন। স্পেন ও পর্তুগাল উভয় দেশেই তীব্র গণবিক্ষোভ দেখা দেয়-এটা কিছুদিনের মধ্যে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে’র রূপ ধারণ করে। এই যুদ্ধই ইতিহাসে ‘উপদ্বীপের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত হয়েছে।
ইতিমধ্যে রাশিয়াতেও মহাদেশীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনক্ষোভ দেখা দেয়। ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে টিলসিটের সন্ধিতে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থাকে বহাল করার অনুকূলে সম্মতি জানানোর পর থেকেই রাশিয়ার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে থাকে। রুশ সরকার ক্ষতির হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্য পূর্ব সম্মতি প্রত্যাহার করে নেন ও ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে অবরোধ নাকচ করে দেন। রাশিয়ার বৈরীসুলভ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নেপোলিয়ান রাশিয়া আক্রমণ করেন। সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রুশবাসীদের জাতীয়তাবোধের আঘাতে তাঁর অভিযান বিফল হয়। তাঁর সুমহান সেনাদল যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। মস্কো অভিযানের বিপর্যয়ে এ পর্যন্ত পদানত পরাধীন জাতিগুলি এক অকৃত্রিম জাতীয়তাবোধে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং নেপোলিয়ানের অন্যায় ও দমনমূলক সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস সাধনে ব্যাপৃত হয়। এমন কি হল্যাণ্ডের সিংহাসনে আসীন তাঁর নিজ ভ্রাতা লুইস নেপোলিয়ান চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পদত্যাগ করেন। মহাদেশীয় অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াতে যখন সারা ইউরোপ উত্তাল, তখন ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ধূমায়িত হতে থাকে। বিরামহীন যুদ্ধের ব্যয়ভার চাপে ফরাসী জনগণের কাঁধে, তারা হয় নতুন করভারে জর্জরিত। অর্থনৈতিক মন্দা, অভাব, অনটন, সর্বোপরি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের নির্দেশে ফরাসীরা নিদারুণভাবে মর্মাহত হয়। তাঁদের মন থেকে নেপোলিয়ান-প্রীতি উধাও হয়ে যায়। নেপোলিয়ানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অর্থশালী বুর্জোয়া শ্রেণী উদাসীন হয়ে পড়ে। চতুর্দিকে নেপোলিয়ানের মহাদেশীয় নীতি সমালোচিত হতে থাকে। এই সুযোগে নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় দীর্ঘস্থায়ী সর্বনাশা আক্রমণ ও প্রতিরোধের পালা। প্রমাণিত হয় মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার অবাস্তবতা। অর্থনৈতিক যুদ্ধের পন্থা গ্রহণ করে নেপোলিয়ান নৌ-শক্তিসম্পন্ন বৃটেনকে পরাস্ত করতে তো পারেনই নি, বরং তার আঘাতে উদভ্রান্ত হয়ে নেপোলিয়ানের মিত্ররা একে একে তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। মহাদেশীয় অবরোধের বাস্তব ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বড় আকারে দেখা দিয়েছিল তার মানসিক প্রতিক্রিয়া। সারা ইউরোপ মানসিকভাবে নেপোলিয়ানের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তাই ‘মহাদেশীয় অবরোধ’ প্রথাই তাঁর পতনের সূচনা করে।