হরপ্পাবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস
হরপ্পা সভ্যতার মতো বিশাল সভ্যতায় ধর্মব্যবস্থা কেমন ছিল অর্থাৎ তৎকালীন মানুষ কীভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত, কোন ধর্মের প্রতি তাদের আসক্তি ছিল প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য খুবই অপ্রতুল। কারণ, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো অথবা অন্য কোনো শহর থেকে দেবায়তনের কোনো স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এছাড়া সীলমোহরগুলিতে উৎকীর্ণ লিপিগুলির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় সেগুলিও এ সম্পর্কে নীরব। এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত মাতৃ মূর্তি, কিছু লিঙ্গজাতীয় প্রতীক, মহেঞ্জোদারোর স্নানাগারটির উপস্থিতি ও সীলমোহরগুলি আলোচ্য সভ্যতার ধর্মীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। হরপ্পায় প্রাপ্ত একটি সীলে একটি নগ্ন নারীমূর্তি অঙ্কিত আছে। এই মূর্তিটির মাথা নীচের দিকে এবং পা দুটি ওপর দিকে উত্থান ভঙ্গিতে অঙ্কিত। একটি চারাগাছ ঐ নারীমূর্তির গর্ভ থেকে নির্গত হয়েছে। মনে হয়, পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর ইঙ্গিত তুলে ধরা হয়েছে এই মূর্তিটির মাধ্যমে। ঐ সীলমোহরটির অপরদিকে একটি দেবীমূর্তির সামনে নরবলি দেবার চিত্র উপস্থিত। আবার অনেক সীলমোহরে গাছপালার উপাসনার নিদর্শন বিদ্যমান। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হল, একটি সীলমোহরে অঙ্কিত একটি পিপুল গাছের মাঝখানে উপবিষ্ট একজন দেবতার ছবি।
বিভিন্ন প্রাণীর উপাসনা তথা জীবজন্তুর পূজা করার রীতি হরপ্পা সভ্যতার যুগে প্রচলিত ছিল। জীবজন্তুর মধ্যে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়ের পূজার প্রচলন ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া একশৃঙ্গী চতুষ্পদ একটি প্রাণীর (সাধারণভাবে ইউনিকর্ন নামে পরিচিত) অস্তিত্ব প্রচুর পরিমাণে পরিলক্ষিত হয় বেশ কিছু সীলমোহরে। আর একটি সীলমোহরে একটি পুরুষ দেবতার ছবি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পুরুষ দেবতার চারদিক পশুর দ্বারা বেষ্টিত। তিনমুখ বিশিষ্ট এই পুরুষ দেবতা যোগাসনে উপবিষ্ট। আধুনিক কিছু ঐতিহাসিক একে পরবর্তীকালের শিবের আদি পর্যায়ের কোনো দেবতারূপে গণ্য করে থাকেন। এছাড়া, পাথরের তৈরি অজস্র লিঙ্গ ও যোনির প্রতীকের পরিচয় মিলেছে। এগুলি উর্বরা শক্তির পরিচয় দেয়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় যে পোড়ামাটির মাতৃকা মূর্তিগুলি পাওয়া গেছে সেগুলির কটি প্রদেশে একটি সাধারণ আবরণ ছাড়া বাকী অংশ নগ্ন। উল্লেখ্য যে, এই মূর্তিগুলিতে মাতৃত্বসূচক অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ প্রকটভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রচলিত এইসব ধর্মব্যবস্থা থেকে মনে হয় যে, ভারতের প্রাচীনতম ধর্মব্যবস্থায় মাতৃকা পূজা প্রাধান্য লাভ করেছিল। এছাড়া সৃষ্টির মূলে পুরুষ ও স্ত্রী আদর্শের সংযোগ এবং যোগ-সাধনা এই ধর্ম ব্যবস্থার মূলে কাজ করেছিল। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন যে, সামগ্রিকভাবে ঐ সমস্ত বিষয়গুলির দ্বারা এমন একটি ধর্মীয় ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে আদিম তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে অভিন্ন বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।