কেমন করে দাস প্রথা রোমের কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছিল ?

দাস প্রথা ও রোমের কৃষি অর্থনীতি

কেমন করে দাস প্রথা রোমের কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছিল ?


   রোমের কৃষিক্ষেত্রে ঠিক কোন সময় থেকে দাসশ্রমের নিয়মিত প্রচলন হয় তা আমাদের অজানা। অনুমান করা যায় রাজতান্ত্রিক আমল থেকেই রোমের অভিজাতবর্গ বড়ো বড়ো খামারের ক্ষেত্রে দাসশ্রমের প্রয়োগ করতেন। কারণ প্রজাতন্ত্রের গোড়ারদিকে বারো টেবিলের আইন পাশের সময় (প্রাঃপ্রঃ ৪৫০ অব্দ) রোমে দাসপ্রথা চালু ছিলো বলে পরবর্তীকালের সূত্র থেকে জানা যায়। কিন্তু সমসাময়িক উপাদান থেকে মনে হয় দাসব্যবস্থা তখনও পর্যন্ত রোমের কৃষিক্ষেত্রে প্রধান শ্রমের যোগানদার হয়ে ওঠেনি। উৎপাদন প্রধানত পরিচালিত হতো ছোটো ও মাঝারি উৎপাদকদের দ্বারা। উৎপাদনের প্রধান লক্ষ্য ছিলো গ্রাসাচ্ছাদন।

       পরিস্থিতির বদল ঘটতে শুরু করে প্রাক প্রচলিত চতুর্থ শতাব্দী থেকে। ইতিমধ্যে যুদ্ধ নানাভাবেই ছাপ ফেলেছে রোমান অর্থনীতিতে। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের ফলে রোমের অভিজাতদের (প্যট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান) হাতে প্রচুর জমি আসে। এই জমি কেবল ইটালিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এবং ইটালির উপদ্বীপ অঞ্চলে রোমান অভিজাতরা বিশাল বিশাল খামার তৈরী করে। ল্যাটিফান্ডিয়া (Latifundia) নামে পরিচিত এই সব খামার কয়েক হাজার একর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।

      দ্বিতীয়ত, রোমের সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের সময় রোমান সৈন্যবাহিনীর একটা বড় অংশ ছিলো ছোট থেকে মাঝারি স্বাধীন কৃষক। দেশে এবং বিদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকার জন্য এরা জমিতে যথেষ্ট সময় দিতে পারতো না। জমি অনাবাদী থাকতো। তা ছাড়া বিজিত অঞ্চলগুলিতে জমি বন্টন শুরু হলে ভাগ্যান্বেষণের আশায় অনেক কৃষক বাইরে চলে গিয়েছিলো। এর ফলে ল্যাটিফান্ডিয়া গুলিতে আবাদের জন্য রোমান অভিজাতদের প্রয়োজন ছিলো বিপুল বাড়তি শ্রমশক্তির।

    বাড়তি শ্রমশক্তির যোগান দিয়েছিলো দাসেরা। স্বেচ্ছায় নয়। বিজিত অঞ্চলগুলির সাধারণ নাগরিকদেরই বন্দি করে নিয়ে এসে বিক্রি করা হতো দাস হিসেবে। এইভাবে দাসকেন্দ্রিক শ্রমশক্তির এক নিরবচ্ছিন্ন যোগান রোমের কৃষিক্ষেত্রে অব্যাহত ছিলো সাম্রাজ্যের বিস্তার কাল পর্যন্ত। প্রিন্সিপেটের সময় থেকেই প্যাক্স রোমানার কারণে (অগাস্টাসের আমল) রোমের সাম্রাজ্যিক বিস্তারে ভাঁটার টান আসে। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে দাসের যোগান কমে আসে ও দাসনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা সংকটের মুখে পড়ে।

        ম্যাক্স ওয়েবার থেকে ফিনলে পর্যন্ত অমার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা এবং পেরি অ্যান্ডারসন ও সাঁ ক্রোয়া-র মতো মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা সকলেই মনে করেছেন, বিজিত অঞ্চলের বন্দিরাই ছিলো দাসদের যোগানের প্রধান উৎস। সাঁ ক্রোয়া মনে করেছেন সাম্রাজ্যিক বিস্তার বন্ধ হয়ে গেলে এবং বাইরে থেকে বন্দি দাসের যোগান কমে এলে নতুন শ্রমশক্তির যোগানের জন্য ভুস্বামীরা দাসেদের অন্তপ্রজননের ওপর বেশি নির্ভর করতে শুরু করে। ইতিপূর্বে দাসদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশা, বিশেষত নারী ও পুরুষের মধ্যে মেলামেশাকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো না। কিন্তু পরবর্তী সময় কৃষিক্ষেত্রে শ্রমশক্তির যোগান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রজনন-সক্ষম নারী ও পুরুষের সহবাসকে উৎসাহ দেওয়া হতো বাসস্থান ও ভূমিখন্ড প্রদানের মাধ্যমে।

      এই পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রভু বা উৎপাদনের উপকরণের মালিক গোষ্ঠীর সম্পর্কে অর্থাৎ উৎপাদনী সম্পর্কে একটা বদল আসে। দাসব্যবস্থার ওপর কৃষিক্ষেত্রের নির্ভরতা কমতে থাকে। কিন্তু মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা সঠিক ভাবেই দেখিয়েছেন যে, রোমান সাম্রাজ্যের প্রসারণের সময় দাসশ্রমের সাহায্যেই রোমের কৃষিব্যবস্থা উদবৃত্ত উৎপাদনে সক্ষম ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন