ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের কারণ
সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বিপ্লব ছিল গৃহযুদ্ধ। স্টুয়ার্ড যুদ্ধের প্রাথমিক পর্ব থেকে রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্লামেন্টের যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ৪০ এর দশকে তার চূড়ান্ত পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। এই চূড়ান্ত পরিণতি হল ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের কারণ হিসাবে আর্থ সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পটভূমির কথা বলা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল 1640 খ্রীষ্টাব্দের লং পার্লামেন্ট।
অধ্যাপক ক্রিষ্টফর হিল গৃহযুদ্ধে পটভূমির প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের কৃষির অবস্থার কথা বলা যায়। সপ্তদশ শতকের সূচনায় ইংল্যান্ড ছিল মূলত একটি কৃষি প্রধান দেশ। জনগণের বেশীরভাগই গ্রামে বাস করত এবং কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। 1510- 1580 খ্রীঃ মধ্যে ইংল্যান্ডের মূল্য বিপ্লবের ফলে খাদ্য সামগ্রীর মূল্য প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ চরম দুরাবস্তার সম্মুখীন হয়। কিন্তু আভিজাত সম্প্রদায় ও জেন্টিরা এতে উপকৃত হয়। কারণ তারা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। অন্যদিকে কৃষির মালিকানার ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অষ্টম হেনরী ইংল্যান্ডের পোপ পন্থীগুলির বিলোপ সাধন করেন এবং তাদের বিশাল ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এর ফলে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে জমির ক্রয়-বিক্রয়ের হাত ধরে পুঁজিবাদী কৃষক শ্রেণীর উৎপত্তি হয়েছিল। এদের মালিকানার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল। শুধু কৃষিতে নয় শিল্পের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
সামাজিক কারণেও ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের অভিজাত বা জেন্টি শ্রেণীরা সভার সদস্য ছিল। এই যুগে ইংল্যান্ডের শিল্প, কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যে এই সামাজিক শ্রেণীর বহুল প্রভাব ছিল। এই প্রভাবকে বাধা দিতে অপর এক শক্তি তৎপর হয়ে ওঠে।
ইংল্যান্ডে স্টুয়ার্ড বংশীয় রাজারা ছিলেন রোমান ক্যাথোলিক ইংল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ট প্রজা সাধারণের উপর সংখ্যা লঘিষ্ঠের ধর্মীয় মতবাদ অর্থাৎ রোমান ক্যাথোলিক ধর্মীয় মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস কখনোই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট বা প্রজাসাধারণ মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের পিউরিটান মতালম্বী উগ্র প্রোটেস্টানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই পিউরিটানরা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার্থে দৃঢ় সংকলবদ্ধ ছিলেন। এই রকম পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধ আসন্ন হয়ে উঠেছিল।
পিউরিটানরা সংবিধানিক অধিকারসমূহ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষাথেও সচেষ্ট হয়েছিল। স্টুয়ার্ড রাজাদের দ্বৈব অধিকার তত্ত্ব ইংল্যান্ডের সাংবিধানিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলেছিল। পার্লামেন্ট রাজশক্তির সংঘর্ষের এটা অন্যতম কারণ ছিল। রাজস্ব বিভাগকে শক্তিশালী করতে প্রথম ২ জন স্টুয়ার্ড বংশীয় শাসক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তার ফলে পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজশক্তির নতুন সংঘাত শুরু হয়েছিল। পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া আমদানির উপর শুল্ক স্থাপন পার্লামেন্ট কখনই মেনে নিতে পারেনা। 1628 খ্রীঃ পার্লামেন্টে ঘোষণা করে পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া শুল্ক আদায়, বন্দি করা বা গ্রেফতারির নির্দেশ এবং স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠন রাজার পক্ষে অবৈধ। চার্লস এর সময়কালে এ নিয়ে পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজশক্তির সংঘাত চলেছিল। যার অনিবার্য ফল ছিল গৃহযুদ্ধ।
এই রকম পরিস্থিতিতে চালর্স 1640 খ্রীঃ পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন। 1660 খ্রীঃ পর্যন্ত এই অধিবেশন চলেছিল। এটি লং পার্লামেন্ট বা দীর্ঘ পার্লামেন্ট নামে পরিচিত। স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করার জন্য পার্লামেন্ট কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। (ক) পার্লামেন্টে রাজার স্বৈরাতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম দুটি হাতিয়ার স্টার চেম্বার এবং হাই কমিশন আদালত গুলিতে বিলুপ্ত করে। (খ) একাদশ বৎসর ব্যাপী স্বৈরাতান্ত্রিক যুগে যে সমস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল সেগুলি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
এইভাবে রাজশক্তির বিভিন্ন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। 1642 খ্রীঃ 1 জুন পার্লামেন্ট রাজাকে Nineteen Propositions নামে একটি চরম পত্র প্রেরণ করে। চালর্স এই চরমপত্র মেনে নিতে অস্বীকার করলে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। ফলে এর চরম পরিণতি হিসেবে 1642 খ্রীঃ-এর আগস্ট মাসে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।